মানষনেত্রও বোধহয় আমার মতো অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-কী বলতে চাচ্ছিস? খুলে বলতো।
-আমি আর নাইম একে অপরকে খুব ভালোবাসি। প্রায় তিনমাস হচ্ছে আমাদের সম্পর্কের। সে তো আমার জন্য পাগলপ্রায়। একদিন সে বলল, আমাকে না দেখলে রাতে নাকি তার ঘুম হয় না। সে আমাকে এমনভাবে কনভিন্স করলো যে আমি তাকে প্রায় প্রতিরাতে বাসার ভেতরে ঢুকতে দিতাম। সবাই তখন ঘুমিয়ে থাকতো। আর তুমি ল্যাবে কাজ করতে। আমরা অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলতাম। সে তোমার কথাও জিজ্ঞেস করতো। আমি বলতাম তুমি ল্যাবে কাউকে ঢুকতে দাও না। কিন্তু নাইম আমাকে আমাকে কনভিন্স করে ছাড়লো। তার নাকি খুব শখ ল্যাবের ভেতরটা দেখা। তাছাড়া সে সরকারী মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ছে। তোমার ল্যাব থেকে নাকি অনেক কিছু শিখতে পারবে। তাই একদিন তোমার ল্যাবের চাবি চুরি করে নাঈমকে দিয়েছিলাম। সেটা থেকে সে আরেকটা নকল চাবি বানিয়ে নিয়েছিল। তখন তুমি থাইল্যান্ডে। সে প্রায়ই প্রতিদিন তোমার ল্যাবে ঢুকতো। আমিও থাকতাম সাথে। কিন্তু তার অভিসন্ধি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি আমাকে। এখন বুঝতে পারছি…
-আপনারও দোষ কম নয় দাদা। আপনি এত মূল্যবান ফাইলগুলো ল্যাবের এক কোণায় ফেলে রেখেছিলেন কেন? চুরি নাহলেও ইঁদুর ঠিকই কেটে কুচি কুচি করতো।
-আপনারা অস্থির হবেন না। নাদের আলী এখনও হাসপাতালে। তার ছেলেরা নিশ্চয়ই বাবাকে দেখতে যাবে। ওখানে আমাদের পুলিশ আছে। আমি বলে দিচ্ছি দেখা মাত্রই যেন ওদের গ্রেফতার করা হয়।
-আপনার ওপর অনেক ধকল গেছে। এখন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিন। পরে আপনাকে ডেকে নিয়ে কিছু ফর্মালিটিজ পূরণ করে নিব।
-কী ভাবছো?
-ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবছি। এখনও অনেক কিছু অমীমাংসিত।
-কিছুই অমীমাংসিত নেই আর। মানষনেত্রের অন্য সত্ত্বাটাই সুলোচনা আর নীলিমাকে হিপনোটাইজ করতো। আর তোদের সাথেও একই কাজ করেছে। তার ঐ সত্ত্বাটা সুলোচনাকে বেঈমান মনে করতো। দিবাকরও ওর কল্পনার সৃষ্টি। এজন্য নিজের ঔরষজাত সন্তানকেও অবৈধ ভাবতো। সব অঘটন তার রোগের কারণেই ঘটেছে। মাল্টিপল পারসোনালিটিতে একসাথে দুই, তিন বা অনেক সত্তা থাকতে পারে। ভালো, খারাপ, বিপজ্জনক যে কোন রকম হতে পারে। মানষনেত্রের দ্বিতীয় সত্তাটা সন্দেহপ্রবণ ও মন্দ চরিত্রের।
-অনেক সময় হতাশা, অপ্রাপ্তি, আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণে মানসিক চাপ থেকে এই রোগটার সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা বলতে, ডিপ কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সম্ভব। মস্তিষ্কের প্রশান্তির জন্য কিছু মেডিসিন আছে। সেগুলোও কাউন্সেলিং এর সময় দেয়া হয়।
-আগে বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। সবাই অস্থির হয়ে আছে তোমার জন্য। সাবিহাও এখন ভালো আছে। আজকে এগারোটায় রিলিজ দেবে। এইতো আর কিছুক্ষণ পর। এখন তো সকাল আটটা বেজে গেছে। তুমি একেবারে বাসায় গিয়ে দেখে এসো। ঠিক আছে?
-এখন কেমন আছো সাবিহা?
-ভালো। পেটের সেলাইটা গতকাল ড্রেসিং করে এসেছি। ওখানে একটু ব্যথা আছে।
-মাত্র ছয়দিনে ক্ষত শুকায় নাকি? তোর রেস্ট নেয়া উচিত ছিল। কে বলেছে পার্কে আসতে?
সাবিহা হেসে বলল,
-রেস্ট নিতে নিতে আমি ক্লান্ত। তোকেও দেখতে ইচ্ছে করছিল। বাসায় বললে তো আসতে দিত না। তাই এই সাত সকালে কাউকে না বলে চুপিচুপি চলে এসেছি। জানতাম তোকে এখানে পাবো। আর আমার তো এই সুন্দর প্রকৃতি দেখে শরীর, মন সব ফুরফুরে লাগছে।
-খুব খারাপ করেছিস তুই। আমি তো তোকে দেখতে যেতামই। গতকালও তো গিয়েছি।
-আমার জন্য তোমাদের কতো সমস্যা হলো! সাবিহাও অনেক কষ্ট ভোগ করছে। আমি কী বলে যে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো…
-এই নিয়ে কয়বার সরি বলেছো হিসাব আছে? আরেকবার সরি বললে কিন্তু খুব খারাপ হবে। চোখ রাঙিয়ে বললাম আমি।
-আচ্ছা আর সরি বলব না…
বলেই জিব কামড়ালো। আমরা তিনজনেই একসাথে হেসে উঠলাম। তখনই আমার মোবাইলে কল এলো। ওসি কামরুজ্জামান সাহেব ফোন করেছেন। কী বলবেন আবার কে জানে!
-হ্যালো।
ওপাশ থেকে ওসি সাহেব অমায়িক কণ্ঠে বললেন,
-কেমন আছেন? সকাল সকাল বিরক্ত করলাম না তো?
-না না। আমার সকালে উঠার অভ্যাস আছে। তো কী খবর?
-খবর তো খুবই চমকপ্রদ।
আমি মনে মনে উৎকণ্ঠিত হলাম। মুখে সেটা প্রকাশ না করে বললাম,
-তাই নাকি! কী খবর বলুন তো।
-ডা. মানষনেত্রের মালটিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডার নেই। তিনি একেবারে সুস্থ মানুষ।
-তারমানে তিনিই কালপ্রিট? আমার আর সাবিহার সাথে যা করেছেন স্বজ্ঞানে করেছেন?
ওসি সাহেব দ্রুত বললেন,
-না না। তিনি নির্দোষ। হয়েছে কি, ঐ নাঈম ছেলেটাই করেছে সব। কিন্তু অন্য একজনের নির্দেশে।
আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম,
-দয়া করে সব খুলে বলুন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-নাঈম যে মেডিকেল কলেজে পড়ে তার চক্ষুরোগ ডিপার্টমেন্টের হেড ডা. মান্নান ভূইয়ার সাথে মানষনেত্রের পুরনো শত্রুতা ছিল। তিনি যখন জানতে পারেন নাঈমের বাবা মানষনেত্রের বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরী করে তখনই প্ল্যান তৈরি করেন। যদি নাঈম তার কথামতো কাজ করে তাহলে তার পড়ালেখার সব খরচ তিনি নিজে বহন করবেন। আর এফসিপিএস, এফআরসিএস এর মতো বড় বড় ডিগ্রিগুলো অর্জনের জন্য নাঈমকে তিনিই দেশের বাইরে পাঠাবেন। তার বাবার পক্ষে এই খরচগুলো করা সম্ভব না। তাই সে ডা. ভূইয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়।
-কী! ডাঃ মানষনেত্রকে হিপনোটাইজ করেছে! এটা কীভাবে সম্ভব!
-হ্যাঁ এটাই সম্ভব হয়েছে। নাঈম নিজের মুখে স্বীকার করেছে সব। একদিন বিকেলে সাধারণভাবে মানষনেত্রের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তখনই করেছে এসব। ড্রইংরুমে হিপনোটাইজ লাইটটাও নাকি সেই লাগিয়েছিল। তারপর, মিসেস রায়, নীলিমা, সাবিহা ও আপনাকে ডা. মানষনেত্র হিপনোটাইজ করেছে নাঈমের নির্দেশে। তিনি যা যা করতেন সম্মোহিত অবস্থাতেই করতেন। সম্মোহনভাব কেটে গেলে আর কিছুই মনে থাকতো না তার। ভাগ্যিস তিনি ল্যাবে গোপন ক্যামেরা লাগিয়েছিলেন। নাহয় তাকে অসুস্থ মনে করে সব দোষ তার ওপরই চাপানো হতো। কৃত্রিম চোখগুলোও কে চুরি করেছে সেটাও এত সহজে জানতে পারতাম না। দেখা যেত মানষনেত্র মানসিক রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন আর ডা. ভূঁইয়া কৃত্রিম চোখের উদ্ভাবক হয়ে সুনাম কুড়াচ্ছেন।
-নাঈম বলল, আত্মভোলা ও দূর্বল মনের মানুষকে নাকি সহজেই হিপনোটাইজ করা যায়। যাক সব ভালোই ভালোই চুকে গেছে। গতরাতেই আমরা ডা. ভূইয়াকে অ্যারেস্ট করেছি। এখন বাকী জীবন জেল হাজতে বসে বসে ডাক্তারি করতে পারবে। আর নাদের আলী, নাঈম, নাহিদ এদেরও আশা করি ভালো রকম শাস্তি হবে। এরাও ভূইয়ার ষড়যন্ত্রের সহযোগী ছিল।
-ডা. মানষনেত্র জানেন এসব?
-এখনও না। তার জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে সামনাসামনিই বলব। তার ঐ অদ্ভুত রোগটা নেই জানলে তিনিও খুশি হবেন।
-কে ফোন করেছিল?
-ওসি সাহেব।
-কী বলেছেন? খারাপ কিছু না তো?
মনে মনে বললাম, খারাপ আর কী হবে? যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। মুখে বললাম,
-তোমাদের বাসায় যাচ্ছেন।
নীলিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-তাহলে তো আমাকেও যেতে হয়। তোমরাও এসো না আমার সাথে।
-আজ না। সাবিহা পুরোপুরি সুস্থ হলে তখন যাব। আর ফোনে যোগাযোগ তো হবেই।
সাবিহার প্রশ্নে স্বম্বিৎ ফিরে পেলাম। তারপর বললাম,
-চল তোকে বাসায় পৌঁছে দিই।
-হুম চল। কিন্তু তোর মনে কী চলছে সেটা তো বলছিস না।
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম,
-এ কয়দিন ভেবে চলেছিলাম, এত সব ঘটনার পেছনে কে দায়ী হতে পারে। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হবে নীলিমার বাবার রোগটার জন্যই এতকিছু হয়েছে। আবার এটাও ঠিক নীলিমা নাঈমকে অন্ধ বিশ্বাস করেছে বলে তার বাবার এতদিনের পরিশ্রম চুরি হয়েছে। কিন্তু ওসি সাহেবের ফোন আসার পর বুঝতে পারলাম আসলে সবকিছুর জন্য দায়ী একজনই।
-কে?
-নীলিমা।
-নীলিমা!
-আমরা মানুষ দেখে চিনতে পারি না, সে কেমন, তার অভিসন্ধি কী। কারণ আমরা একটা মানুষকে বাহ্যিক দৃষ্টি দিয়ে দেখি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমাদের বাহ্যিক দুটো চোখ ছাড়াও অন্য একটা চোখ দিয়েছেন। সেটাকে আমরা সিক্সথ সেন্স বলতে পারি, দূরদৃষ্টি বলতে পারি অথবা মনের শক্তি বলতে পারি। এটাকে কাজে লাগিয়েই বুঝতে হবে কে কেমন, কার মনে কী চলছে।
-কীরে, কী দেখছিস এমন করে?
-আসলে আমি অবাক হয়ে গেছি। তুই এত সুন্দর করে কথা বলতে পারিস আগে তো জানতাম না!
-আগে আমিও অনেক কিছু জানতাম না, বুঝতাম না। এখন নীলিমার ঘটনাটা দেখে কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।
-তারমানে তোর অন্যচোখটা খুলে গেছে!
-ঠিক তাই।